সূত্রঃ প্রথম আলো (16/09/2015)
সংগ্রহেঃ মোঃ মাইনউদ্দিন পাটওয়ারী।
ওপরের ফোন নম্বরটি সবাই নিজেদের মোবাইলে সেভ করে রাখুন। ১০৯২১। মনে রাখার জন্য বলা যায়, দশ নয় দুই এক। কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে, বখাটেদের আক্রমণের মুখে পড়লে অথবা অপমানিত হওয়ার আশঙ্কা করলে সঙ্গে সঙ্গে এই নম্বরে ফোন করে সাহায্য চাইবেন। এর জন্য কোনো চার্জ দিতে হবে না। টোল ফ্রি। সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা। যেকোনো মোবাইল অপারেটরের সিম ও টিঅ্যান্ডটি নম্বর থেকে ফোন করা যাবে।
সরকারের এ উদ্যোগের কথা আমরা অনেকে জানি না বলে এর সুফল থেকে বঞ্চিত হই। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টোরাল প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল হোসেন এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি জানান। গত সপ্তাহে প্রথম আলো ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে নগরীতে নারীর নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেখানে অনেক কথার মধ্যে এই টোল ফ্রি নম্বরের কথা উঠলে বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সবাই একবাক্যে বললেন, এই নার্সারির কথা সবার জানা থাকলে নারী নির্যাতন রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হবে।
কয়েক মাস আগেও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রথম আলোর অপর এক গোলটেবিল বৈঠকে আবুল হোসেন এ তথ্যটি দিয়ে বলেছিলেন, এটা যেন আমরা পত্রিকায় প্রচারের ব্যবস্থা করি। আমরা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে নম্বরটি ছাপাই। আমরা চেয়েছি সবাই জানুক। যেকোনো নারী ঘরে-বাইরে বিপদে পড়লে তাঁর জরুরি সাহায্য পাওয়ার যে একটি সহজ উপায় আছে, সেটা সবার জানা থাকা খুব জরুরি।
আমি জানি, এ পর্যন্ত পড়ে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দেবে, নম্বরটি কি শুধু সরকারি খাতায় আছে, নাকি কাজে দেয়? এ রকম ভাবা স্বাভাবিক। এ বিষয়ে আমি আসছি একটু পরেই।
এখন সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। এই তো গতকালের পত্রিকায়ও অন্তত তিন তরুণীর নির্যাতিত হওয়ার দুঃসংবাদ বেরিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের খারাপ খবর পত্রিকার পাতা ছেয়ে থাকে। পুলিশ গ্রেপ্তারও করে। তারপরও চলছে এই বর্বরতা। কারণ, একশ্রেণির বখাটে লোক মনে করে মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে সহজেই পার পাওয়া যায়। অবাক হয়ে ভাবি, আমাদের সমাজটা এত খারাপ লোকে ভরে গেছে? অথচ গর্ব করে বলি, আমরা মধ্য আয়ের দেশের প্রথম ধাপে পা রেখেছি!
সভায় প্রধান অতিথি পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বললেন, ষাটের দশকে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে আন্দোলন করেছি। তখন নারীর প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল, আজ সেই মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। কিন্তু এ অবস্থা বদলে দেওয়া যায়। আমাদের পরিবার ও স্কুল থেকেই নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে পুলিশের মনোভঙ্গিতে (মাইন্ডসেট) আমূল পরিবর্তন আসছে। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ভূমিকা বাড়ানো হচ্ছে। একজন মন্ত্রী যখন দায়িত্ব নিয়ে এ কথা বলেন, আমরা নিশ্চয়ই আশান্বিত হই।
পুলিশ হেডকোয়ার্টারের এআইজি রখফার সুলতানা খানমও নারী ও শিশু নির্যাতনের কথা পুলিশকে জানানোর আহ্বান জানিয়ে বললেন, দেশে আটটি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নির্যাতনের শিকার নারীদের সব রকম সহায়তা দেওয়া হয়। প্রয়োজনের তুলনায় এসব ব্যবস্থা খুব কম হলেও যতটুকু আছে, তার গুরুত্বই বা কম কী? তা ছাড়া এখানে শুধু সরকার নয়, সঙ্গে বেসরকারি সংস্থাগুলোও সহযোগিতা করছে।
ধরা যাক এই রাজধানী ঢাকারই কথা। দেড় কোটি মানুষের মধ্যে প্রতিদিন অন্তত ২০ থেকে ৩০ লাখ মানুষ বাইরে বের হন। নানা কাজে অফিস-আদালতে যান, ফুটপাত থেকে শুরু করে শপিং মলে কেনাকাটা করেন। তাঁদের প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ১০ থেকে ১৫ লাখ নারী। তাঁদের বাসে চলাফেরার ব্যবস্থা খুবই খারাপ। নগরীতে শৌচাগার বলতে তেমন কিছু নেই। থাকলেও নারীদের জন্য কতটা নিরাপদ, তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। নারীদের জন্য আমাদের প্রিয় এই রাজধানী খুবই প্রতিকূল হয়ে উঠছে। পথেঘাটে প্রতিনিয়ত নারীর প্রতি অবমাননা আমাদের চোখের সামনেই ঘটে চলেছে। আমরা পুরুষেরা দেখেও দেখি না। প্রতিবাদে খুব কমই সোচ্চার হই।
অবশ্য মেয়র আনিসুল হক জানিয়েছেন, এক বছরের মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন চোখে পড়তে শুরু করবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় অন্তত ১০০ আধুনিক টয়লেট তাঁরা নির্মাণ করছেন। সেখানে স্বচ্ছন্দে ও নিরাপদে নারীরা যেতে পারবেন। এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হবে। নগরীতে নারীদের জন্য বিশেষ বাস সার্ভিস চালু হবে। সেখানে চালক, হেলপার সবাই হবেন নারী। আশা করি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকা ও বড় শহরগুলোতেও একই উদ্যোগ নেওয়া হবে। তাহলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে শুরু করবে।
আমরা অবাক হই, যখন দেখি বাসে ভিড় ঠেলে ওঠার সময় বাস-হেলপাররা নারী যাত্রীদের গায়ে হাত দেন। বাসস্ট্যান্ডে বাস থামতে না থামতেই আবার নারীদের গায়ে হাত দিয়ে ঠেলে নামিয়ে দেন ওঁরা। আমাদের মতো অনেক পুরুষ যাত্রী প্রতিবাদ করি না, সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে চাই না। অথচ দু-চারজন একটু কড়া সুরে ধমক দিলে অবস্থা বদলে দেওয়া যায়। কারণ, আমাদের সমাজ সহজে অন্যায় মেনে নেয় না। তবে প্রতিবাদের শুরুটাই গুরুত্বপূর্ণ। নারীর প্রতি সহিংসতা ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে যে ফল পাওয়া যায়, তা এই কয়েক দিনের ঘটনায়ই বলে দেয়।
নারী নির্যাতনের যেকোনো ঘটনার প্রতিবাদে এলাকার মানুষ আজকাল রাজপথে নামে। মানববন্ধন হয়। প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষে ঘটনা উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। অপরাধী ধরে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
কিন্তু তারপর কী হয়? এটাই প্রশ্ন। এর সদুত্তর দিতে পারলে আজ নারীর প্রতি সহিংসতা অনেক কমে আসত। এই তো সেদিন, নববর্ষে টিএসসি-সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় কিছু বখাটে ছেলে কয়েকজন তরুণীকে লাঞ্ছিত করল। তার বিচার হলো কোথায়? সিসিটিভিতে অভিযুক্ত অপরাধীদের কিছু ছবি পাওয়া গেল। পুলিশ ঘটা করে সেসব ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানাল। লাখ টাকা পুরস্কারের কথাও তারা বলল। কিন্তু একজন অভিযুক্তকেও ধরা গেল না। এটা কি বিশ্বাস করা যায় যে পুলিশ তাদের ধরতে পারে না? যেখানে র্যা ব-পুলিশ অভিযুক্ত জঙ্গিদের টপাটপ ধরছে, সেখানে নববর্ষে নারীর অবমাননাকারীদের কেন ধরা যাবে না? যেখানে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা লিটন নন্দী একজন অভিযুক্তকে ধরে পুলিশে দিলেন, তাঁকে পর্যন্ত পুলিশ আটক করে রাখতে পারল না। এটা যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির তাই সংগতভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন, আমরা যে মধ্য আয়ের দেশ গড়ে তুলছি, সেটা কি শুধু পুরুষদের নিয়েই হবে?
মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়শা খানম আক্ষেপ করে বলেন, এ দেশে একজন নারী পুলিশ সদস্য তাঁর পুলিশ স্বামীর হাতেও নির্যাতিত হন। এরপর আমরা মুখ দেখাই কী করে?
আমরা শুরু করেছিলাম ১০৯২১ নম্বরটি দিয়ে। এই নম্বরে ফোন করে একজন নারী কি তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়ার আশা করতে পারেন? সরকারি ব্যবস্থার ওপর আমাদের ভরসা নানা কারণেই কম। কিন্তু অন্তত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেনের কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে এই নম্বরটি আমেরিকার ৯১১ চেম্বারটির মতো কাজ করে। সবাই জানেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিপদ-আপদ বা হঠাৎ জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে ৯১১ নম্বরে ফোন করলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসে প্রতিকারের ব্যবস্থা করে। আমাদের দেশে হয়তো এতটা আশা করা যাবে না। কিন্তু যদি শুধু নারী নির্যাতন রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার উপায় হিসেবে এই নম্বরটি কাজে দেয়, তাহলে সেটা আমাদের দেশের জন্য একটা বিপ্লবের মতোই ব্যাপার হবে।
১০৯২১ একটি হান্টিং নম্বর। একসঙ্গে ৩০টি ফোন রিসিভ করা যায়। যদি কোনো বিপন্ন নারী এই নম্বরে ফোন করে জরুরি সাহায্য চান, তাহলে তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলের জরুরি খবর স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, পুলিশ প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট এনজিও সংগঠন—এই চার জায়গায় একই সঙ্গে পাঠানো হয়। ফলে প্রতিকারের একটি নিশ্চয়তা অবশ্যই রয়েছে। এখন প্রতিদিন গড়ে ১৮০ থেকে ২০০টি কল আসে সাহায্য চেয়ে।
সচেতন প্রত্যেক নাগরিক এই নম্বরটি যাঁর যাঁর মোবাইল ফোনের স্পিড ডায়ালে বা জরুরি নম্বরের কোটায় সেভ করে রাখুন। কোনো নারী বিপদে পড়লে বা বখাটেদের আক্রমণের শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে ডায়াল করুন ১০৯২১ নম্বরে।
তবে কেউ যেন এই নম্বরের অপব্যবহার করবেন না। বিপদের সহায়টি আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com