ঘর থেকে ধরে নিয়ে ২ নারীর সঙ্গে বর্বরতা
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ১৯:৩২ | আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ২৩:২৬
কেবল অভিযোগ এনেই ক্ষান্ত হয়নি ‘সমাজপতি’রা। তিনজনকে প্রকাশ্যে গ্রামের সবার সামনে রশি দিয়ে বেঁধে পিটিয়েছে। কানে ধরে উঠবস করিয়েছে। গত ২৯ আগস্ট সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কেড়াগাছি ইউনিয়নের পাঁচপোতা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। প্রবাসীর স্ত্রী সুলতানা (ছদ্মনাম, বয়স ২৬) এ নির্যাতনের বিচার চেয়ে মামলা করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুলিশ তাঁকে সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
১২ দিন আগে এ ঘটনা ঘটলেও সুলতানা ও তাঁর স্বজনরা বিষয়টি কাউকে জানায়নি। কিন্তু সম্প্রতি ওই নির্যাতনের ছবি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
সুলতানা সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা। প্রায় ১২ বছর আগে একই উপজেলার কেড়াগাছি ইউনিয়নের পাঁচপোতা গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহিমের (ছদ্মনাম) সঙ্গে সুলতানার বিয়ে হয়। রহিম তিন বছর ধরে মালয়েশিয়ায় চাকরি করছেন।
উত্ত্যক্ত করা থেকে শুরু
পাঁচপোতা গ্রামে মেয়ে টুনিকে (ছদ্মনাম, বয়স ৬) নিয়ে একাই থাকতেন সুলতানা। পাশে অন্য এক বাড়িতে থাকতেন সুলতানার বৃদ্ধা শ্বাশুড়ি। সুলতানা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘স্বামী রহিমের অনুপস্থিতির সুযোগে রহিমের ভাগ্নে বিল্লাল হোসেন প্রায়ই আমাকে উত্ত্যক্ত করত। বিল্লাল একই গ্রামের বাসিন্দা।’ সুলতানা অভিযোগ করেন, বিল্লাল চোরাচালানের কাজ করে। সে তাঁর (সুলতানা) মুঠোফোনের নম্বর চেয়েও না পাওয়ায় আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়। বিল্লাল তাঁর (সুলতানা) বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে অশোভন কথা বলে বেড়াত।
সুলতানা আরো জানান, কিছুদিন আগে মালয়েশিয়া থেকে বাড়ি ফিরে আসেন স্বামী রহিমের ভাই মোস্তফা মোড়ল। মোস্তফার সঙ্গে রহিমের জমির সীমানা নিয়ে বিরোধ ছিল। বিল্লাল এই সুযোগে মোস্তফার পক্ষ নিয়ে রহিমের অনুপস্থিতিতে সুলতানা সম্পর্কে আরো বেশি করে কটূক্তি করতে থাকে। এ ঘটনার পর গত চার মাস আগে সুলতানা তাঁর ভাই ওমর শরিফের সঙ্গে নিজ গ্রাম রামকৃষ্ণপুর চলে যান।
‘সমাজপতি’দের কীর্তি
সুলতানা জানান, বাড়িঘর দেখার জন্য গত ২৭ আগস্ট মেয়ে টুনি ও নিজের খালাতো বোন পারভীন খাতুনকে (ছদ্মনাম) নিয়ে গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে যান তিনি। একদিন পর গত ২৯ আগস্ট পারভীনের স্বামী আরিফুর রহমানও (ছদ্মনাম) যান তাঁদের বাড়িতে। দুপুরে তাঁরা রান্না করার পাশাপাশি গল্প করছিলেন। তখনই ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ে বিল্লাল ও মোস্তফা মোড়ল। সুলতানা জানান, ওই দুজনের সঙ্গে একই গ্রামের রুহুল কুদ্দুস, জিয়া, জোহর, লাল্টু, ভোলা, ইসমাইল, ইমান মুহুরি, আশরাফুল, কাওসারসহ আরো কয়েকজন ছিল। তারা নিজেদের সমাজপতি বলে পরিচয় দেয়।
সুলতানা জানান, বিল্লাল ও মোস্তফা তাঁর বোন রুমা ও জাহিদের পরিচয় জানতে চায়। তিনি বলেন, ‘আমি তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেই। এ সময় বিল্লাল ও তাঁর লোকজন পারভীন ও আরিফের বিয়ের কাগজপত্র দেখতে চায়। আমি বলি গত দেড় বছর আগে তাঁদের বিয়ে হয়েছে। আর বিয়ের কাগজপত্র তো সঙ্গে থাকে না। এরপরই তারা ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। বলে, নগদ দিন, তাহলে আমরা কোনো ক্ষতি করব না।’
সুলতানা বলেন, ‘আমি ওদের (বিল্লাল ও অন্যান্য) টাকা দিতে আপত্তি জানাই। এরপরই তারা ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর করতে থাকে। এ সময় তারা নগদ টাকা, গলার চেইন, মুঠোফোনসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। কুদ্দুস নামের লোকটি আমাকে চড় মারতে থাকে। এরপরই গরু বাঁধার রশি এনে আমাদের তিনজনকেই হাতে ও পিঠে বেঁধে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে। এরপর বাঁশের লাঠি ও কুড়ালের আছাড় খুলে মারধর করে আমাদের।’
সুলতানা বলেন, ‘যন্ত্রণায় চিৎকার করলেও এলাকার ছেলে, মেয়ে ও বয়স্ক ব্যক্তিরা এতে উৎসাহ জুগিয়ে উল্লাস করতে থাকে। এভাবে বেশ কয়েক মিনিট ধরে মারধর করার পর আমাদের রশি দিয়ে টেনে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে প্রতিবেশী কমিউনিটি পুলিশ সদস্য ইসমাইলের বাড়িতে নিয়ে যায়। ওখানে আবারও আমাদের মারধর করা হয়। এরপর একশবার কান ধরে ওঠবস করায়।’
সুলতানা বলেন, ‘বারবার চিৎকার দিয়ে বলেছি আমাদের কোনো দোষ নেই, আমাদের ছেড়ে দিন, আমাদের মারবেন না।’
সুলতানা জানান, গ্রাম পুলিশ ইব্রাহীমসহ শতাধিক নারী-পুরুষ তা প্রত্যক্ষ করেও ছিলেন নির্বিকার। সুলতানার বৃদ্ধা ও অসুস্থ শাশুড়ির আকুতিও এসব ব্যক্তিরা শোনেননি।’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চিৎকার শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন কেড়াগাছি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. ফারুক হোসেন ও তাঁর ছেলে সবুজ। ফারুক ‘সমাজপতি’দের কাছ থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে রশির বাঁধন খুলে দেন। এরপরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন সুলতানা। পারভীন ও আরিফ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকেন। পরে তাঁরা অন্যদের সহযোগিতা নিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন।
সুলতানা জানান, অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকলেও কেউ এক গ্লাস পানিও খাওয়াতে আসেনি। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফারুক বলেন, ‘সুলতানা অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল। আমি গ্রামের চিকিৎসককে ডেকে আনি।’
সুলতানার ভাই শওকত হোসেন (ছদ্মনাম) বলেন, ‘রাত ১২টায় বোনের ওপর নির্যাতনের কথা জানতে পারি। ওই রাতেই আমি ও আমার কাকা সুলতানাকে কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করাই।’
অবশেষে মামলা, থানার গড়িমসি
সুলতানা জানান, লোকলজ্জা এবং পরবর্তী বিপদ-আপদের আশঙ্কায় নির্যাতনের কথা চেপে রাখেন তিনি। পরে গত ৬ সেপ্টেম্বর সুলতানা বাদী হয়ে কলারোয়া থানায় একটি মামলা করেন। সুলতানা দাবি করেন, ‘থানার উপপরিদর্শক মোয়াজ্জেম হোসেনকে যা বলেছি তা তিনি লেখেননি। একই কথা বারবার বলতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘মামলায় নাম দিয়েছিলাম মোট ২০ জনের। অথচ এতে লেখা হয়েছে মাত্র তিনজনের নাম।’
এ ব্যাপারে কলারোয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘এজাহারভুক্ত আসামিরা হচ্ছে রুহুল কুদ্দুস, বিল্লাল ও ইসমাইল। এ ছাড়া অজ্ঞাত আসামি হিসেবে আরো দু-তিনজন রয়েছে।’
সুলতানা অভিযোগ করেন, ‘রুহুল কুদ্দুস তিনদিনের মাথায় জামিনে বাড়ি এসে আমাকে হুমকি দিচ্ছে।’ এ ব্যাপারে মোয়াজ্জেম বলেন, এ ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতনের ১০ ধারায় ও ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে মামলা হয়েছে। কুদ্দুসকে গত ১ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থী হিসেবে কুদ্দুস জামিন পেয়েছে বলে শুনেছি। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কয়েকজন পলাতক। তবে বিল্লাল, ইসমাইল, মোস্তফাসহ কেউ কেউ এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
কেড়াগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভুট্টোলাল গাইন বলেন, ‘ঘটনা জানার পরই আমি সেখানে যাই। সুলতানাকে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছি আমি।’
এদিকে ঘটনার শিকার পারভীনের মা আলেয়া বেগম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমার মেয়ে ও মেয়ের স্বামী আরিফ ঘটনার পর থেকে ভেঙে পড়েছে। কেবলই আত্মহনন করার কথা বলছে।’