আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। থামছে না। পড়ছে তো পড়ছেই। এখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা হবে। দেখে মনে হচ্ছে কত রাত।
বর্ষার দিনগুলোতে বোধ হয় পোকামাকড়ের সঙ্গে ভূতগুলোও জেগে ওঠে। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় সোহমদের পাড়ার একটা ভূতের দুষ্টুমি করার ইচ্ছে হল। ভাবল আজ সোহমকে একটু ভয় দেখানো যেতে পারে।
সোহম এখন পড়তে বসেছে। বাবা অফিসে। ফিরতে রাত হবে। মা বলল, সোহম একটু গ্রিলের তালাটা লাগিয়ে দে না, বাবা। আমি এক বার রঘুদার দোকান যাচ্ছি।
হ্যাঁ, আসছি। সোহম ওখানে বসেই বলল।
মা যাবার সময় বলল, আর শোন কুকারে তিনটে সিটি পড়লে গ্যাসটা অফ করে দিস। আমি এক্ষুনি ফিরব।
সোহম ঘাড় নেড়ে হাসল। সে জানে মা এখুনি ফিরবে না। দোকানে ভিড় থাকে। পাড়ার ভেতর দোকান। সবাই ওখানেই কেনাকাটা করে। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। গল্প জমে যায়। বাড়ি ফেরার কথা মায়ের খেয়াল থাকে না।
সোহম নিজেও চাইছিল মা আজ দেরি করেই ফিরুক। অনেকগুলো অঙ্ক কষতে বাকি আছে। মা সকালে দিয়েছিল। হয়নি। পুরনো, কষা অঙ্ক। মা আর সাহায্য করবে না। কিন্তু অঙ্কগুলো মাথাতে ঢুকছে না। একটু সময় দরকার। নিরিবিলি হলে ভাল হয়।
বৃষ্টি পড়ছেই। ঠান্ডা হাওয়াতে সোহমের গা শিরশির করে উঠল। ‘এই যাঃ’— কারেন্ট যেতেই সোহম নিজে নিজেই বলে উঠল। চার্জার লাইটটা জ্বালাল। বাইরে জমাট অন্ধকার। একটানা ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক। সোহম বেশ মুশকিলে পড়েছে। অঙ্কগুলো মিলছেই না। কোনও কোনও দিন এ রকম হয়। মাথা যেন একেবারেই কাজ করে না। ভূতটা ভাবল এই সুযোগ। হঠাৎ গ্রিলের বারান্দায় একটা শব্দ হল। এখন আবার কে রে বাবা! সোহমের ভেতর অঙ্ক না পারার একটা বিরক্তি আছে।
কে? সোহম জানতে চাইল।
কেউ উত্তর দিল না।
সোহম আবার পড়ায় মন দিল। আবার একটা আওয়াজ হল। কে রে বাবা? সোহম বিরক্তি নিয়ে বলল।
আমি। একটা পাতলা গলায় উত্তর এল।
আমি কে?
আমি।
কী মুশকিল। আমিটা কে? কী নাম? সোহম ওখানে বসে বসে বলল।
অন্ধকারে একটা লোক বারান্দা দিয়ে গিয়ে সোহমের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। মুখটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। তবে মনে হচ্ছে খুব সাধারণ চেহারার একটা মানুষ। সোহমের এতক্ষণে খেয়াল হল গ্রিলের দরজায় তালা দিতে সে ভুলে গিয়েছে।
লোকটা সোহমের অচেনা। ওদের পাড়ায় থাকে কি? কী জানি? সোহম মনে করতে পারল না। বৃষ্টির জন্য লোকটা বোধ হয় ঢুকে পড়েছে। সোহম আর ভাবতে পারল না। ওর অঙ্কের তাড়া আছে। বলল, ভেতরে সোফাতে এসে বসো।
লোকটা সোফাতে এসে বসল। চার্জার লাইটটা হঠাৎ দিপ্ দিপ্ করতে থাকল। এটাও বন্ধ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। লোকটা আলোর মুখটা সোহমের দিকে ঘুরিয়ে দিতেই সব ঠিক হয়ে গেল। আলোটা আর কাঁপছে না।
অন্ধকারে লোকটা বসে আছে। চুপচাপ। হঠাৎ বলল, তোমার সাহস তো খুব দেখছি।
কেন, তুমি বাঘ না ভালুক, যে তোমায় দেখে ভয় পাব?
যাঃ বাবা। এ তো বেশ ডানপিটে।
সোহম বলল, অঙ্ক জানো?
অঙ্ক? লোকটা কী যেন ভাবছে। ওরে বাবা! কোথায় এসে পড়লাম!
কেন, জানো না নাকি? লসাগু-গসাগু-র অঙ্ক, দশমিকের অঙ্ক, ভগ্নাংশের অঙ্ক এ সব জানো?
লোকটা থতমত খেল। না মানে জানি কিন্তু...
জানো যখন, তখন কিন্তু কিন্তু করছ কেন? এই অঙ্কগুলো করতে একটু হেল্প করলে তো পারো।
হেল্প?
কেন, হেল্প করতে পারবে না? আমি বাড়িতে মা-বাবাকে কত হেল্প করি জানো?
লোকটা দু’পাশে ঘাড় নাড়াল। ভয় দেখাতে এসে এ সব কী হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না।
সোহম বলে চলেছে, বাবাকে আমি চশমা, খবরের কাগজ এনে দিই। মাকে ভাজা জোয়ানের কৌটো এনে দিই। এই রে! সোহম চমকে উঠল। মায়ের কথায় মনে পড়ল, তুমি এক কাজ করো না আঙ্কেল, গ্যাসটা অফ করে দাও না। ইস! একদম ভুল গেছি।
লোকটা আবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোল। এ কী রে বাবা। কী করতে এসে কী কাজ করছি। অবশ্য অঙ্কের চেয়ে ভাল। অঙ্ক মানেই তো সেই যোগ, ভাগ, গুণ, হাতে রাখো, মাথায় রাখো, দশমিক বিন্দু... উফ!
আঙ্কেল শোনো। সোহম ডাক দিল। আসার সময় টেবিল থেকে একটা জলের বোতল নিয়ে এসো। আর এই আলোটা নিয়ে যাও।
লোকটা আলো নিল না। জলের বোতল এনে দিল।
সোহম জল খেয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। গ্যাসটা অফ করেছ?
হুঁ। লোকটা উত্তর দিল।
হুঁ কী? ভাল করে হ্যাঁ বলতে পারো না। যাকগে গ্যাস অফ করার জন্য আর এক বার থ্যাঙ্ক ইউ। বেশ আর কোনও কাজ নেই। এ বার অঙ্কগুলো একটু দ্যাখো।
লোকটা সাড়া দিল না। চুপ করে বসে থাকল। আবার সেই অঙ্ক? কত বার যে অঙ্কের জন্য কত বকা খেয়েছে তার হিসেব নেই। শুধু কি বকা? বেঞ্চের ওপর দাঁড়ানো, কানমলা অনেক শাস্তি গেছে।
বসে আছো কেন? সোহম মুখ তুলল। প্লিজ, একটু হেল্প করো না। জানো তো এগুলো করেই আমাকে আবার, এই রে!
কী হল? লোকটা জানতে চাইল। আঙ্কেল ওই ঘরে আমার স্কুলব্যাগটা আছে নিয়ে এসো না, প্লিজ। লোকটা উঠল। সোহম আলো দেখাতে চাইল।
লোকটা বলল, আলো লাগবে না, এখুনি এনে দিচ্ছি। বলতে বলতেই পাশের ঘর থেকে ব্যাগ চলে এল। সোহম খুশি। থ্যাঙ্ক ইউ আঙ্কেল। তুমি তো ম্যাজিক জানো মনে হচ্ছে। সোহম ব্যাগ থেকে একটা পেনসিল বক্স বের করে বলল, আঙ্কেল আমি পেনসিলগুলো কল দিয়ে ছুলে নিচ্ছি তুমি ততক্ষণে আমার অঙ্কগুলো একটু পড়ে দেখো।
লোকটা আবার ঘাবড়ে গেল। না, না। বরং বক্সটা আমাকে দাও। লোকটা সোহমের হাত থেকে পেনসিল বক্সটা কেড়ে নিল।
সোহম অঙ্কে মন দিল। কী বিচ্ছিরি অঙ্ক রে বাবা! কিছুতেই হচ্ছে না। সোহম জানে অঙ্কগুলো না হলে আজ নিশ্চিত বকা খাবে। আঙ্কেল তো চেষ্টাই করছে না। পেনসিল ছোলা হয়ে গেছে। কী করা যায়। আর এক বার বলা যেতে পারে।
আঙ্কেল প্লিজ, অঙ্কগুলো একটু দ্যাখো না। সোহমের এ বার বলার ধরনটা সত্যিই নরম।
লোকটা ভাবল এ কোথায় এসে পড়লাম রে বাবা! কী চিটেল ছেলে ভাই। এতগুলো কাজ করাল কিন্তু অঙ্ক না করিয়ে ছাড়বে না দেখছি। নাঃ, এখানে আর থাকা যায় না। বেরোতে হবে।
কী হল, এক বার অঙ্কগুলো ট্রাই করো না।
লোকটা কান্না কান্না গলায় বলল, আবার অঙ্ক?
তুমি অঙ্কে খুব ভয় পাও, তাই না?
হুঁ।
আবার হুঁ।
লোকটা দুঃখ দুঃখ মুখ করে হাসল।
অঙ্ক ভয় পেলে কিন্তু চলবে না। অঙ্ক বারবার কষতে হবে। অঙ্ক বুঝে বুঝে করতে হবে। তবেই তো অঙ্ক শিখবে নাকি? সোহম হঠাৎ নিজে বিজ্ঞের মতো বলে চলল। নাও এই অঙ্কগুলো ছোটদের অঙ্ক, তুমি নিশ্চয় পারবে। এক বার ভাল করে মন দিয়ে দ্যাখো দেখি।
লোকটা এ বার যেতে পারলে বাঁচে। মিনমিনে গলায় বলল, অঙ্ক আমি অনেক করেছি, কিন্তু একটাও মেলেনি।
মেলেনি?
নাঃ, কোনও দিনই মেলেনি। আজও সব মিলল না।
সোহম এ বার জোরে হেসে উঠল। তুমি তো অঙ্কে আমার চেয়েও উইক দেখছি। আরে উত্তর না মিললে তো... সোহমের কথা শেষ হওয়ার আগেই সোহমের মায়ের গলা শোনা গেল। গ্রিলের দরজায় তালা দিসনি কেন? কে এসেছে রে সোহম, কার সঙ্গে কথা বলছিস?
সোহম আঙ্কেলের কথা বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ মুখ তুলে দেখে আঙ্কেল নেই। অঙ্কের ভয়ে ভূতটা তখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।