পাঁচ বছর পর দেশে ফিরলেন, তবে লাশ হয়ে। বিস্তারিত পড়ুন...



১০ বছর আগে জর্ডান গিয়েছিলেন মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার আঁখি। চুক্তি অনুযায়ী ৫ বছর কাজ করার পর দেশে ফিরে আসেন তিনি। পরে আবারও পাড়ি জমান লেবানন। সেখানে কাজ করার ৫ বছর পর আবারও দেশে ফেরেন। তবে এবার আর জীবিত আসতে পারলেন না। দেশে আসলো তার লাশ।
ঝরনা বেগম। ৩ ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে সংসার তার। বড় ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী, মেজো ছেলে ৭ম শ্রেণী এবং ছোট ছেলে ৫ম শ্রেণীতে পড়ে। মেয়েটি এখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। স্বামীর পেশা রঙমিস্ত্রি। একজনের আয়-রোজগারে সন্তানদের লেখাপড়াসহ সংসার চলছিল খুব কষ্টে। তাই স্বামীকে সাহায্য করতে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। যাওয়ার আগে তাকে বলা হয়েছিল দুই বাচ্চা দেখাশোনা করতে হবে তাকে। কিন্তু জর্ডান পৌঁছানোর পর বুঝতে পারেন রিক্রুটিং এজেন্সি ও সংশ্লিষ্ট দালাল তাকে ধোঁকা দিয়েছে। এক অন্ধকার জগতে এসে পড়েছেন তিনি। সেখানে তার ওপর চলছে ভয়াবহ নির্যাতন। কিন্তু এ অন্ধকার গহ্বর থেকে বেরোনোর উপায়ও তার জানা নেই। অচেনা এক দেশে তাকে সাহায্য করার মতোও কেউ নেই। কয়েকবার দেশে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হলেও গত এক সপ্তাহ তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি পরিবার।
একই কারণে আসমা গিয়েছিলেন ওমানে। তাকেও গৃহকর্মীর কাজ দেয়ার কথা ছিল। শুনেছিলেন গৃহকর্তা ফুল খুব পছন্দ করে। তাই নিজের হাতে লাগানো গাঁদা ফুল নিয়ে গত জুলাই মাসের ৭ তারিখে বিমানে চড়ে বসেন। কিন্তু ওই বিমানে ওঠা পর্যন্তই। আজ অবধি খোঁজ মেলেনি তার। আদৌ দেশটিতে পৌঁছতে পেরেছেন কি না বা পৌঁছালে কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন তার খবর নেই কারও কাছে। আসমার শোকে তার মাও মারা গেছেন। এক বছর আগে রুনা আক্তার গিয়েছিলেন লেবানন। যাওয়ার পর থেকে বেতন পাননি তিনি। বেতন না দিলেও দুই-তিন মাসের মতো যোগাযোগ ছিল পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু এরপর থেকে তারও কোন খোঁজ মিলছে না।
শুধু ঝরনা, আসমা কিংবা রুনা নয়। বিদেশে পাড়ি জমানোর পর সন্ধান মিলছে না এ রকম শ শ বাংলাদেশী নারীর। যারা সে দেশে যাওয়ার পর কেউ নিয়োগকর্তার কাছে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কেউ আবার রিক্রুটিং এজেন্সি মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছেন। কেউ আবার জেলজীবন পার করছেন। আবার কেউ লাশ হয়ে ফিরছেন দেশে। চলতি বছর বিদেশের মাটিতে লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন ৬ বাংলাদেশী নারীকর্মী। যার মধ্যে এপ্রিলেই এসেছে ৩ জনের লাশ। এছাড়া ঠিকমতো বেতন না পাওয়া, এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাচার হওয়া, শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার ও নিখোঁজ হওয়া কম্পক্ষে দুশ’ নারীকর্মীর পরিবার সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করেছে। এছাড়া নারী অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন (বমসা)-তে প্রতিমাসে গড়ে ২৫-৩০টি অভিযোগে পড়ে। তাদের দেয়া তথ্যমতে, চলতি বছর দুই শতাধিকেরও বেশি অভিযোগ পড়েছে। এছাড়া তারা উদ্যোগী হয়ে লাশ এনেছেন ৬টি। সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বিভিন্ন সংস্থায় অভিযোগকারী এসব পরিবার ভিকটিমদের দ্রুত উদ্ধার করে ফেরত আনার দাবি জানিয়েছে।
সম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে নারীকর্মী রপ্তানি বাড়ছে। ধারাবাহিকভাবে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশে নারীকর্মী যাওয়ার দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে জর্ডান, লেবানন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও কাতার। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-র পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৭ সালে ১৯ হাজার ৯৪ জন, ২০০৮ সালে ২০ হাজার ৮৪২ জন, ২০০৯ সালে ২২ হাজার ২২৪ জন, ২০১০ সালে ২৭ হাজার ৭০৬ জন, ২০১১ সালে ৩০ হাজার ৫৭৯ জন, ২০১২ সালে ৩৭ হাজার ৩০৪ জন, ২০১৩ সালে ৫৬ হাজার ৪০০ জন, ২০১৪ সালে ৭৬ হাজার ৭ জন এবং এ বছরের জুলাই পর্যন্ত গেছে ৫৬ হাজার ৩৮৯ জন নারীকর্মী বিদেশে গেছেন। তবে সময়ের সঙ্গে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরা এবং সে দেশে সন্ধান না পাওয়া নারীকর্মীদের অভিযোগও বাড়ছে।
সূত্রমতে, নারীকর্মীরা গড়ে প্রতি মাসে ৩০টি অভিযোগ করেন বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশী অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের (বমসা) কাছে। নানা সমস্যার কারণে বছরে পাঁচ শতাধিক নারীকর্মী দেশে ফিরে আসেন।
সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডান, ওমান, লেবানন ও কাতারে নির্যাতনের মাত্রা বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়ে জর্ডান গমন করা নারীকর্মীদের পরিবারের পক্ষ থেকে। সহজ কাজের প্রলোভন দেখিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি এবং সংশ্লিষ্ট দালালরা তাদের বিদেশ পাঠায়। আবার অনেকে গার্মেন্টে কাজ দেয়ার কথা বলে কাজ দিচ্ছে গৃহকর্মীর। আবার অনেকে সেসব দেশ থেকেই এসব নারীকর্মীদের পাচার করে দিচ্ছে অন্য কোন দেশে।
সিংগাইরের আঁখি দু’দফা বিদেশে গমনের শেষবার গিয়েছিলেন লেবাননে। চুক্তি অনুযায়ী ৫ বছর মেয়াদ শেষ করে দেশে ফিরে আসতে চাইলে নিয়োগকর্তা নতুন কর্মী না আসা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে বলেন। সে অনুযায়ী সম্মত হন তিনি। এর কিছুদিন পর বাড়িতে ফোন করে ১৫ দিন পরে বাড়ি আসবেন বলে জানান। দেশে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটাও শেষ করেছেন বলে জানান। কিন্তু পরের সপ্তাহে ফোন করলে গৃহকর্তার স্ত্রী জানান, আঁখি অসুস্থ। এরও এক সপ্তাহ পরে দূতাবাস থেকে ফোন করে জানায় সে মারা গেছে। পরে ডেথ সার্টিফিকেটে দেখা যায় তার মানসিক সমস্যা ছিল। পরিবারের প্রশ্ন- মানসিক সমস্যা থাকলে সে কিভাবে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বিদেশের মাটিতে কাজ করেছিল। পরে আঁখির পরিবার বমসাতে আবেদন করলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ১৫ই এপ্রিল লাশ দেশে আনে। তবে আজও মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ মেলেনি। একই মাসে লাশ আসে বিদেশে কাজ করা নারীকর্মী ময়মনসিংহের সাথীসহ আরও একজনের। এছাড়া চলতি বছর সংস্থাটির সহযোগিতায় আরও তিনটি লাশ এসেছে।
ঝরনা বেগমের দেবর আবদুর রহমান জানান, ঝরনার স্বামীর কাজের সূত্রে পরিচয় হয় জাহাঙ্গীর নামে গাজীপুরের এক দালালের সঙ্গে। সে তার স্ত্রীকে জর্ডান পাঠানোর পরামর্শ দেয়। জাহাঙ্গীর তাকে বলে সেখানে একটি পরিবারে দুটো বাচ্চা দেখাশোনা করতে হবে। দালাল তাদের একটি রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা নেয়া হয়। কিন্তু সে দেশে যাওয়ার পর কথা-কাজে কোন মিল পাননি ঝরনা। তাকে যে পরিবারে কাজ দেয়া হয়েছে সেই পরিবারে কোন মহিলা নেই। কোন বাচ্চাও নেই। গৃহকর্তারা ৪ ভাই। তারা পালাক্রমে তার ওপর নির্যাতন চালায়। তাৎক্ষণিকভাবে এ অবস্থা জানতো না দেশে থাকা পরিবার। পরে একদিন বিদেশী একটি নাম্বার থেকে মিসকল দেখে কল ব্যাক করলে তার পরিবার বিষয়টি জানতে পারে। এরপর অনেকবার ফোন করলেও কেউ ফোন ধরেনি। পরে ওমান থাকা এক স্বজনের মাধ্যমে খোঁজ পায় ঝরনার। তিনি জানান, গৃহকর্তারা বলেছে- তারা তাকে ৪ লাখ টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে। তাই ফেরত দেবে না। গত সপ্তাহে একবার ফোন দিলেও রিসিভ করে কথা বলেনি। এদিকে এর আগে দালাল জাহাঙ্গীর ভিকটিমের সঙ্গে পরিবারের কথা বলিয়ে দিতে ২০ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন। ওই দাবি মোতাবেক তাকে ১৫ হাজার টাকা দিলে একবার যোগাযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু এরপর আর যোগাযোগ করতে পারেনি। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরের সঙ্গেও এখন আর যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা।
আসমা বেগমের স্বামী কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ওমান যাওয়ার আগে দালালের মাধ্যমে জানতে পারে তার মালিক খুব ফুল ভালবাসে। তাই সে যাওয়ার সময় নিজ হাতে লাগানো গাঁদা ফুল নিয়ে যায়। কিন্তু গত ৭ই জুলাই বিমানে ওঠার পর থেকেই তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেন না। তিনি জানান, চাঁদপুরের জহির আলীর সঙ্গে তার এলাকার এক ব্যক্তির যোগাযোগ ছিল। সে-ই দালাল জহিরের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেয়। জহির বিদেশ যাওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রলোভন দেখাতো। তার প্রলোভনে পড়ে ৬০ হাজার টাকা খরচ করে স্ত্রীকে বিদেশ পাঠান। এখন দালালও ফোন রিসিভ করে না। পেশায় রিকশাচালক আসমার স্বামী বলেন, তার ২ সন্তানের মধ্যে ছেলেটা প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। আর মেয়েটার বয়স ১ বছর। তিনি আরও জানান, আসমা চলে যাওয়ার কয়েক দিন পর তার শ্বাশুড়ি (আসমার মা) শোকে মারা গেছেন। বলেন, মেয়ের নাম নিতে নিতেই তিনি মারা গেছেন। তিনি জানান, আসমার সন্ধান করে ফেরত আনতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে তিনি গত মাসের ১৪ই জুলাই আবেদন করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি।
এক বছর আগে লেবানন গেছেন রুনা আক্তার। যাওয়ার পর ২-৩ মাস কথা হয়েছিল। একটি বাসায় কাজ করতো। কিন্তু কোন বেতন দেয়া হয়নি। এরপর গত ৮-৯ মাস ধরে তার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ নেই। এখন কোথায়, কিভাবে আছেন কিছুই জানে না পরিবার।
মে মাসের ১৩ তারিখে সামিরা ট্রাভেলস-এর মাধ্যমে দুবাই যান নাসিমা। তাকে ৭৫০ দিরহামে গৃহকর্মীর কাজ দেয়ার কথা ছিল। গত ৬ই রমজান স্বামীর সঙ্গে তার শেষ কথা হয়েছিল। তার স্বামী জানান, ওই সময় রুনা জানিয়েছিল সে দেশে নিয়ে গিয়ে তাকে কয়েকজন পুরুষের কাছে দেয়া হয়। কিন্তু তারা তাকে পছন্দ না করায় একটি বড় বাসায় কাজ করতে দিয়েছিল। সেখানে ১১টি কক্ষ এবং ৮টি বাথরুম পরিষ্কার করতে হতো। দিনে এক বেলা খাবার দিতো। তাছাড়া খুব মারধর করতো। রুনা তার স্বামীকে আরও জানিয়েছিল, ওই বাড়িতে মহিলারা থাকতো। রাতে তারা একেকজন পুরুষের সঙ্গে চলে যেত। ভোরবেলা ফিরে আসতো। এ ব্যাপারে এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, এগুলো বাজে কথা। তাছাড়া দালাল তাকে বলেছে এখন ফিরিয়ে আনতে হলে ২ লাখ টাকা লাগবে। রুনার স্বামী আরও জানান, বর্তমান সেদেশের এজেন্সির অফিসে অবস্থান করছে। না খেয়ে তার পেটে অসুখ হয়ে গেছে।
ইস্ট ওয়েস্ট ট্রেড লিংকারস-এর মাধ্যমে দুবাই যান রোকসানা। তাকে সেখানে গার্মেন্টে কাজ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজ দেয় বাসায়। পরে এজেন্সি তাকে ওমানে পাচার করে দেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ধরনের প্রায় দুই শতাধিক নারীকর্মীর পরিবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। এদের কেউ কেউ ফেরত আসলেও অধিকাংশই নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি দপ্তরেও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট এজেন্সির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ করলেও অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এ ব্যাপারে বমসা চেয়ারম্যান লিলি জাহান বলেন, তাদের কাছে যেসব অভিযোগ আসে সেগুলো হলো- ঠিকমতো খাবার না দেয়া, মারধর, শারীরিক নির্যাতন, অসুস্থ হলে চিকিৎসা না করানো ইত্যাদি। চলতি বছরে এ ধরনের দুই শতাধিক অভিযোগ এসেছে। তিনি বলেন, বিদেশ গমনের আগে যাদের ট্রেনিং দেয়া হয় তাদের থাকার ব্যবস্থাও নিরাপদ নয়। এ বাবদ ৩-৪ হাজার টাকা নিলেও ঠিকমতো নিরাপত্তা দেয় না। তাছাড়া যে দেশে তাদের পাঠানো হয় সেখানকার পরিবেশ অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। এজন্য সংশ্লিষ্ট দেশে কাজ করে আসা নারীকর্মীদের দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে তারা বেশি উপকৃত হবে বলে জানান। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীরা যেন দ্রুত ক্ষতিপূরণ পান তারও দাবি জানান তিনি। 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post