এ কেমন বর্বরতা, এ কেমন হত্যা!


এ কেমন বর্বরতা, এ কেমন হত্যা!

rajon
সিলেট: কিশোর রাজনের চোখে বাঁধভাঙা জল। চোখ মুখ ফুলে গেছে। প্রহারে প্রহারে ক্লান্ত। শরীর ক্ষতবিক্ষত। একটা খুঁটিতে পিছমোড়া করে বাঁধা সে বারবার করজোরে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। বলছে, সে চোর নয়। তারপরও উৎসাহী জনতা তাদের ‘বীরত্ব’ ফলিয়েছে চোর সন্দেহে ধৃত নিরীহ কিশোরটির ওপর। কিশোরটি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে হতে সামান্য পানি খেতে চেয়েছিল। দৃষ্কৃতকারীরা তাকে বলেছে ‘পানি নাই, ঘাম খা’। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া অবধি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হলো তাকে। আর প্রচণ্ড উল্লাসে সেই মধ্যযুগীয় বর্বর ঘটনার ভিডিও করেছে তারা। সেই ভিডিও এসেছে বাংলামেইলের কাছে। নির্মম সে ভিডিওটি রীতিমতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সভ্যতাকে, সভ্য মানুষের বিবেককে।
গত বুধবার সিলেট শহরতলীর কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঘটে যাওয়া এ ঘটনা জানাজানি হয়েছে শনিবার রাতে যখন ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে স্থানীয় জনতার হাতে হাতে।
জানা গেছে, বুধবার এ ঘটনার পর দুষ্কৃতকারীরা রাজনের লাশ গুম করার চেষ্টা করে। ওই দিনই পুলিশ লাশসহ দুইজনকে আটক করে। তবে ওই ঘটনা সাধারণ ‘চোর পেটানোর’ ঘটনা হিসেবেই চাপা পড়ে যায়। যখন হাতে হাতে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে এবং ঘটনার নির্মমতা ও বর্বরতা বুঝা যায় তখনই ফুঁসে ওঠলো জনতা। তারা রীতিমতো বিক্ষোভও করেছে। কোনো প্রমাণ নেই, হাতেনাতে ধরার বিষয়টিও নেই। কেবল ‘চোর’ সন্দেহেই ১৩ বছরের কিশোরটিকে পিটিয়ে মারে দুষ্কৃতকারীরা-এমন প্রশ্নই জেগেছে মানুষের মনে।
রাজনের পুরো নাম শেখ সামিউল আলম রাজন। তার বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামে। রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান পেশায় একজন মাইক্রোবাসচালক। তার দুই ছেলের মধ্যে রাজন বড়। অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা রাজন সবজি বিক্রি করত। আর সবজি বিক্রির টাকা দিয়েই চলতো রাজনের পরিবারের খরচ।
গত বুধবার ভোরে সে সবজি বিক্রি করতে বাড়ি থেকে বের হয়। শহরতলীর কুমারগাঁও এলাকায় আসার পর চোর সন্দেহে তাকে আটক করে স্থানীয়রা। কুমারগাও বাসস্ট্যান্ড এলাকার বড়গাঁও সুন্দর আলী ও গাজী লালাই মিয়া মার্কেট সংলগ্ন স্থানে তাকে একটি খুঁটির সঙ্গে হাত-পা বেঁধে টানা আধাঘণ্টা ধরে মারধর করে তারা। তাদের পিটুনিতে মারা যায় রাজন। রাজন মারা গেছে বুঝতে পেরে তার লাশ গুমের চেষ্টা চালায় তারা। লাশ গুমের চেষ্টাকালে মুহিত আলম নামে একজনকে স্থানীয় জনতা আটক করে পুলিশে দেয়। পুলিশ ওইদিন দুপরের দিকে রাজনের লাশ উদ্ধার করে।
কিন্তু তখনও রাজানের বাব-মা জানতেন না যে তার ছেলেকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। রাতে ছেলে বাড়ি না ফেরায় রাজনের বাবা-মা জালালাবাদ থানায় জিডি করতে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন একটি কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এক পর্যায়ে তারা তাদের সন্তানকে সনাক্ত করেন।
আজিজুর জানান- তিনি যেদিন ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালাতে পারেন না, সেদিন সংসার খরচ চালাতে সবজি বিক্রি করতে বের হয় রাজন।
মা লুবনা আক্তার জানান- ওইদিন (বুধবার) রাজনের বাবা গাড়িতে (ভাড়ার ট্রিপে) ছিলেন বলে বাড়ি ফেরেননি। ভোরে টুকেরবাজার থেকে সবজি নিয়ে বিক্রির জন্য রাজন বের হয়েছিল। সারা দিন ছেলের খোঁজ পাননি তারা। রাতে থানায় গিয়ে জিডি করার সময় এক কিশোরের লাশ পাওয়া গেছে জানতে পেরে তারা রাজনকে সনাক্ত করা হয়।
লুবনা বলেন- ‘আমার পুয়া (ছেলে) চোর না। ই কথা সারা এলাকার মানুষ জানে। প্রবাসী অখলতের চোর ধরার সখ পূরণ করতে গিয়া জীবন দিছে আমার পুয়া! আমি এর উচিৎ বিচার চাই।’
এদিকে, নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই জালালাবাদ থানায় চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠছেন এলাকাবাসীও। হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে শুক্রবার বাদ জুম’আ স্থানীয় এলাকাবাসী কুমারগাঁও বাইপাস এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেছে।
এ ঘটনায় রাজনের পিতা বাদি হয়ে জালালাবাদ থানায় একটি হত্যা মামলা (নং-২৯৭/১৫) দায়ের করেন। ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে আটক মুহিত আলমকেও। তার দেয়া তথ্যমতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও উদ্ধার করে। এছাড়াও ওই ভিডিওটি এলাকাবাসীও সংগ্রহ করেছে। রাজনকে নির্যাতনের ২৮ মিনিটের ভিডিও ফুটেজেটি বাংলামেইলের কাছেও রক্ষিত আছে।
ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে নির্মম সেই হত্যার ঘটনা। ভিডিওতে দেখে গেছে, কুমারগাঁও এলাকায় একটি দোকানের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে প্রায় আধা ঘণ্টা নির্যাতন করা হয় ১৩ বছরের কিশোর শেখ সামিউল আলম রাজনকে। বাঁধা অবস্থায় পানির জন্য বেশ কয়েকবার আর্তনাদ করেও রাজনকে পানি দেয়নি নির্যাতনকারীরা। পানি চাইলে নির্যাতনকারীরা তাকে বলেছে ‘পানি নাই ঘাম খা’। কয়েকজন মিলে উল্লাসের সঙ্গে কিশোর রাজনের উপর চালায় অমানবিক নির্যাতন। টানা ২৮ মিনিট বাঁধা অবস্থায় অনেকটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চলে নির্যাতন। কিশোর শরীরে টানা নির্যাতন সইতে না পেরে শেষে পানি খাওয়ার আকুতি জানায়।
ভিডিওচিত্রে তিন-চারজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও ভিডিও ধারণকারী আরও দুজনের উপস্থিতিও দেখা গেছে।
‘এই ক (বল) তুই চোর, তোর নাম ক… লগে কারা আছিল…’ ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চেয়ে মারধর করা হয়। একনাগাড়ে প্রায় ১৬ মিনিট রাজনকে অনেকটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রোল দিয়ে পেটানো হয়। নির্যাতনকারীরা রাজনের নখে, মাথা ও পেটে রোল দিয়ে আঘাত করে এক সময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মুচড়াতেও দেখা যায়।
কয়েক মিনিটের জন্য রাজনকে হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেয়া হয়। ‘হাড়গোড় তো দেখি সব ঠিক আছে, আরও মারো…’ বলে রাজনের বাঁ হাত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আরেকদফা পেটানো হয়। এসময় রাজনের শরীর ও চোখ-মুখ বেশ ফোলা দেখা গেছে। একপর্যায়ে মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রাজন।
নির্যাতনের সময় নির্যাতনকারীদের উল্লাস করতে দেখা গেছে। এছাড়াও নির্যাতনের এক পর্যায়ে সামিউলকে বোতলের কর্ক দিয়ে একজন কয়েক ফোটা পানিও দিতে দেখা গেছে। মারধর করার সময় একদিকে রাজনের মুখে আর্তচিৎকার, আর অন্যদিকে নির্যাতনকারীদের মুখে অট্টহাসি দিয়ে নানা কটূক্তি করতেও শোনা গেছে।
যে ভিডিও ধারণ করার কাজটি করছিল, তাকে নির্দেশ করে নির্যাতনকারীরা জানতে চায়- ঠিকমতো ভিডিও ধারণ হচ্ছে কি-না। ওপাশ থেকে ‘ফেসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব…’ বলতে শোনা গেছে। শেষ দিকে নির্যাতনকারী একজন সঙ্গীদের কাছে জানতে চায়- ‘কিতা করতাম?’ অপর একজনকে তখন ‘মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!’ বলতে শোনা যায়।
এদিকে পুলিশ বাংলামেইলকে জানিয়েছে, লাশটি ওই দিন পর্যন্ত অজ্ঞাত ছিল। খবর পেয়ে বুধবার রাত ১১টায় থানায় গিয়ে পরিবারের সদস্যরা সনাক্ত করার পর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হলে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ ওঠে।
এ ঘটনায় সিলেট মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানায় পুলিশ বাদি হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় রাজনের লাশ গুমের সময় হাতেনাতে আটক মুহিত ও তার ভাই কামরুল ইসলাম (২৪), তাদের সহযোগী আলী হায়দার ওরফে আলী (৩৪) ও চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়নাকে (৪৫) আসামি করা হয়েছে।
জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন বলেন ‘নির্যাতন ভিডিওচিত্রে ধারণ করার বিষয়টি শুনেছি এবং এটি দেখেছেন-এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথাও হয়েছে।’
ওসি জানান- ঘটনার সঙ্গে মামলার আসামি চারজনই সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভিডিওচিত্র ধারণসহ পুরো ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুহিতকে আদালতে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। রোববার আদালতে রিমান্ড আবেদনের শুনানি হবে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post